ইরি ধানের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আপডেট তথ্য ২০২৫

আপনি যদি ইরি ধানের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চান, তাহলে আজকের এই আর্টিকেল হবে আপনার জন্য অনেক উপকারী। ইরি ধানকে অনেক জায়গায় সেচনির্ভর ধান বা শীতকালীন ধানও বলা হয়। সাধারণত ইরি ধানের চাষ করার জন্য ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিতে এর চারা রোপণ করা হয় এবং এপ্রিল-মে মাসে ধান কাটা শুরু হয়। যদি কেউ সঠিক ইরি ধানের চাষ পদ্ধতি মেনে চলে তাহলে প্রতি হেক্টরে ৬–৭ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া সম্ভব। 

বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ, যেখানে ধান উৎপাদন কৃষির মূল কেন্দ্রবিন্দু। ধান আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য, আর এর মধ্যে ইরি ধান (যা মূলত বোরো মৌসুমে চাষ হয়) দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আপনি জানতে পারবেন ইরি ধান কি, ইরি ধানের চাষ পদ্ধতি,ইরি ধান কখন চাষ হয়, ইরি ধানের সার প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে একদম বিস্তারিত।  চলুন ধাপে ধাপে জেনে নিই ইরি ধানের চাষের পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি।

ইরি ধানের চাষ পদ্ধতি

ইরি ধান কি 

ইরি ধান হলো বাংলাদেশের একটি মৌসুমি ধান, যা মূলত শীতকালীন মৌসুমে বা বোরো মৌসুমে  চাষ করা হয় এবং সেচের মাধ্যমে জমিতে পানি দিয়ে উৎপাদিত হয়। এজন্য একে অনেক সময় সেচনির্ভর ধানও বলা হয়।

👉সহজভাবে বলতে গেলে —  

  • বোরো মৌসুমে (ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল) সেচের মাধ্যমে যে ধান চাষ করা হয়, তাকে ইরি ধান বলে।
  • এর চাষে সেচের পাশাপাশি সার, কীটনাশক এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়।
  • ইরি ধান বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত ধান, যা দেশের মোট ধান উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি সরবরাহ করে থাকে।

ইরি ধানের চাষের বৈশিষ্ট্য

  • সেচনির্ভর অর্থাৎ পানি ছাড়া চাষ সম্ভব নয়
  • ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিতে এর চারা রোপণ এবং এপ্রিল থেকে মে মাসের দিকে  ফসল কাটা হয়। 
  • উচ্চ ফলনশীল যা প্রায় প্রতি হেক্টরে ৬–৭ টন পর্যন্ত হয়ে থাকে। 
  • উন্নত জাত যেমন : ব্রি ধান-২৮, ব্রি ধান-২৯, ব্রি ধান-৮১, ব্রি ধান-৮৯
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক অনেক ভালো

কেন ইরি ধানের চাষ গুরুত্বপূর্ণ?

  • দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে
  • কৃষকের আয় বাড়ায়
  • বছরের অন্য মৌসুমের ধানের ঘাটতি পূরণ করে
  • বোরো মৌসুমে উৎপাদনের কারণে ধানের বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখে

আরও পড়ুনঃ টিএসপি সারের কাজ কি, টিএসপি সারের দাম এবং সারের ব্যবহার

ইরি ধানের চাষ পদ্ধতি

বোরো শব্দের উৎপত্তি হয়েছে মূলত হাওর বা বাঁওড় শব্দ থেকেই। এই বোরো ধানগুলো একসময় আমাদের দেশের হাওর ও বাঁওড় এলাকায় চাষ করা হতো।

বোরো মৌসুমে ধানগাছগুলো প্রচুর সূর্যকিরণ পায়, ফলে সার বেশি গ্রহণ করে অথচ গাছ ও পাতা হেলে পড়ে না, আর ফলবান কুশি বেশি হয় এবং ফলনও অধিক মাত্রায় পাওয়া যায়। তাই এই মৌসুমে আধুনিক জাতের বোরো ধানের চাষ সম্প্রসারণ করা অতিমাত্রায় প্রয়োজন।

বোরো ধানের ভালো ফলন পেতে হলে আগে সঠিকভাবে জমি তৈরি করতে হবে, সুষম মাত্রায় জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে এবং সময়মতো চারা রোপণ করাসহ অন্যান্য পরিচর্যা সঠিকভাবে করতে হবে।

ইরি ধানের চাষ পদ্ধতি দেখে নিন; 

i. জমি তৈরী 

ইরি ধানের চারা রোপণের জন্য প্রথমে জমিকে কাদাযুক্ত করে উত্তমরূপে তৈরি করতে হবে। এর জন্য জমিতে প্রয়োজনমতো পানি দেয়ার পর মাটি একটু নরম হলে ১০-১৫ সেন্টিমিটার গভীর করে সোজাসুজি ও আড়াআড়িভাবে চার থেকে পাঁচটি চাষ ও মই দিতে হবে যাতে মাটি থকথকে নরম কাদাময় হয়। 

মনে রাখবেনঃ প্রথম চাষের পর অন্তত সাত দিন জমিতে পানি আটকে রাখা প্রয়োজন। এর ফলে জমির আগাছা ও খড়গুলো পঁচে গিয়ে গাছের জন্য খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবে।  বিশেষ করে এটার ফলে জমিতে অ্যামোনিয়াম নাইট্রোজেন জমিতে বৃদ্ধি পাবে ।

জমি নির্বাচনঃ  

  • মাঝারি উঁচু থেকে উঁচু জমি ইরি ধানের জন্য ভালো।
  • জমিতে যেন পানি ধরে রাখতে পারে, তবে অতিরিক্ত জলাবদ্ধ যেন না হয়।
  • দো-আঁশ ও এঁটেল মাটিতে ইরি ধান সবচেয়ে ভালো জন্মায়।

আবহাওয়ার শর্তঃ 

  • ইরি ধান মূলত শীতকালীন মৌসুমে চাষ করা হয়।
  • ইরি ধানের জন্য ২০–২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সবচেয়ে উপযুক্ত।
  • জমিতে পর্যাপ্ত সূর্যালোক ও সেচের সুবিধা থাকতে হবে।
ইরি ধানের চাষ

বোরো মৌসুমে ধানের আশানুরূপ ফলন পাওয়ার জন্য জমিতে পরিমাণমতো জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হবে। তবে, জাতভেদে বোরো ধানের সারের পরিমাণ হবে (কেজি/হেক্টরে )। 

প্রতি বিঘা জমিতে প্রয়োজনীয় সারঃ  

  • ইউরিয়াঃ ৩০ কেজি
  • টিএসপিঃ  ১২ কেজি
  • এমওপিঃ  ১৫ কেজি
  • জিপসামঃ ৮ কেজি
  • জিঙ্ক সালফেটঃ ১৫০–২০০ গ্রাম

প্রয়োগের ধাপঃ  

  • জমি তৈরির সময় টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও জিঙ্ক দিতে হবে।
  • ইউরিয়া তিন ভাগে প্রয়োগ করতে হবেঃ
    1. রোপণের ১৫ দিন পর
    2. কুশি আসার সময়
    3. শীষ বের হওয়ার আগে

iii. চারা রোপণ

ইরি ধানের চাষের জন্য আপনাকে বীজতলা থেকে ৩০-৩৫ দিন বয়সের চারা সাবধানতার সাথে তুলে এনে জমিতে সারি করে রোপণ করতে হবে। এ মৌসুমে ইরি ধানের চাষের জন্য চারাগুলোকে সারি থেকে সারির দুরুত্ব ২০-২৫ সেন্টিমিটার এবং চারা থেকে চারার দুরুত্ব ১৫-২০ সেন্টিমিটার হতে হবে। 

তবে, জমির উর্বরতা ও জাতের কুশি ছাড়ানোর ওপর নির্ভর করে এর দূরত্ব কম বা বেশি হতে পারে। প্রতি গোছায় দু-তিনটি সুস্থ ও সবল চারাগুলো ২.৫ থেকে ৩.৫ সেন্টিমিটার গভীরে রোপণ করতে হবে। মনে রাখবেন, খুব গভীরে চারা রোপণ করা ঠিক নয়, কেননা এতে কুশি গজাতে অনেক দেরি হয় এবং কুশি ও ছড়া কম হয়। 

কম গভীরে চারা রোপণ করলে চারাগুলোর তাড়াতাড়ি কুশি গজায়, কুশি ও ছড়া বেশি হয় ও ফলন দ্রুত বাড়ে। তাই কম গভীরে চারা রোপণের জন্য  চারা রোপণের সময় জমিতে ১.২৫ সেন্টিমিটারের মতো ছিপছিপে পানি জমে রাখা ভালো। 

কাদাময় অবস্থায় ইরি ধানের চারা রোপণের গভীরতা ঠিক রাখার সুবিধা হয়। এরপর , চারা রোপণের পর জমির এক কোনায় কিছু বাড়তি চারা রেখে দিতে হয়। কারণ, যদি এতে রোপণের ১০-১৫ দিন পরে যেসব জায়গায় চারা মরে যায়, তাহলে সেখানে বাড়তি চারা থেকে শূন্যস্থান পূরণ করা যায়। যার কারণে জমিতে একই বয়সের চারা রোপণ করা হয়।

iv. সেচব্যবস্থা

গাছের প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিলে ইরি ধানের চাষের ক্ষেত্রে সেচের পানির পূর্ণ ব্যবহার হয়। বোরো ধানের ক্ষেত্রে জমিতে সব সময় পানি ধরে রাখতে হবে এমন কোনো বাধা ধরা নিয়ম নেই। তবে, বোরো মৌসুমে সাধারণত ধানের সারা জীবনকালে মোট ১২০ সেন্টিমিটার পানির প্রয়োজন হয়।  কাইচ থোড় আসার সময় থেকে ধানের দুধ হওয়া পর্যন্ত পানির চাহিদা দ্বিগুণ হয়। এ সময় জমিতে পর্যাপ্ত পানি রাখতে হয়। কারণ থোড় ও ফুল অবস্থায় মাটিতে রস না থাকলে ফলন কমে যায়, তাই পর্যাপ্ত পানি দিয়ে রাখতে হবে। 

সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনাঃ 

  • ইরি ধান সেচ নির্ভরশীল হওয়ায় নিয়মিত পানি দিতে হবে।
  • জমিতে সবসময় ৩–৫ সেমিঃ পানি রাখতে হবে।
  • ধান পাকতে শুরু করলে ১০–১২ দিন আগে পানি সরিয়ে দিতে হবে।
ইরি ধানের চাষ পদ্ধতি

আগাছা নিয়ন্ত্রণঃ 

  • রোপণের ১৫–২০ দিনের মধ্যে আগাছা দমন জরুরি।
  • হাতে নিড়ানি বা আগাছানাশক ব্যবহার করা যায়।
  • আগাছা দমন না করলে ফলন কমে যায়।

v. রোগ ও পোকামাকড় দমন

পোকামাকড় দমন করতে না পারলে ইরি ধানের চাষের ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হতে হবে । তাই, আগে থেকেই তা জেনে সঠিক নিয়ম ও প্রতিরোধ বাবস্থা নিতে হবে । 

সাধারণ রোগঃ 

  • ব্লাস্ট রোগ – পাতা ও শীষ আক্রান্ত হয়।
  • পাতার দাগ রোগ –পাতার মধ্যে বাদামি দাগ দেখা দেয়।

সাধারণ পোকাঃ 

  • মাজরা পোকা – চারা গাছের কুশি নষ্ট করে।
  • বাদামি গন্ধি পোকা – ধানের শীষে আক্রমণ করে।

প্রতিকারঃ 

  • রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে।
  • সঠিক নিয়মে সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • কীটনাশক যেমনঃ সাইপারমেথ্রিন বা ফুরাডান প্রয়োগ করতে হবে।

ইরি ধান চাষে করণীয় সতর্কতা

ইরি ধান চাষের ক্ষেত্রে আপনাকে কিছু  সতর্কতা অবলম্বন করতেই হবে । যদি আপনি এই সতর্কতা অবলম্বন না করেন, তাহলে আপনার ইরি ধান চাষে অনেক ক্ষতি হবে বলে ধারনা করা যায়। নিছে দেখে নিন  সব সতর্কতাসমুহঃ 

  • প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করা যাবে না।
  • সেচের পানিতে যেন কীটনাশক বা লবণাক্ততা না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • রোগ-বালাই দেখা দিলে দ্রুত প্রতিকার বাবস্থা নিতে হবে।
  • ইরি ধানের উন্নত জাত ও মানসম্মত বীজ ব্যবহার করতে হবে।

আরও পড়ুনঃ স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি- বীজ বপন পদ্ধতি,গাছের পরিচর্যা ও বীজের দাম

ইরি ধান কখন চাষ হয়

আমি জানি যে আপনার মধ্যে এইরকম একটা প্রশ্ন অনেক আগে থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছে যে ইরি ধান কখন চাষ করা হয় । তাহলে জেনে নিন এই ইরি ধান কখন চাষ হয়! ইরি ধান 

👉 সময়সূচিঃ 

  • বীজতলা তৈরির সময়ঃ নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত।
  • চারা রোপণের সময়ঃ  ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি।
  • ধান কাটার সময়ঃ এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত।

অর্থাৎ, ইরি ধান নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বীজ বপন করা হয় এবং শীতকালে জমিতে চারা রোপণ করা হয়, আর গ্রীষ্মের শুরুতে (এপ্রিল থেকে মে) ফসল কাটা হয়।

পরিশেষে

আমি আশা করি যে আপনি আজকে এই আর্টিকেল এর মাধ্যমে ইরি ধানের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে একদম খুঁটি নাতি তথ্য জানতে পেরেছেন।  তারপর আপনার যদি আরো কিছু জানার থাকে তাহলে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাতে পারেন , আর নিচের কিছু প্রশ্ন উত্তর আছে ইরি ধানের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আপনি সেগুলো দেখবেন। তাহলে অনেকটা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। 

FAQ 

প্রশ্ন ১: ইরি ধানের বীজতলা তৈরির সঠিক সময় কখন?
উত্তর:
নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসে বীজতলা তৈরি করতে হয়।

প্রশ্ন ২: ইরি ধানের চারা কতদিন বয়সে রোপণ করা উচিত?
উত্তর:
৩০–৩৫ দিনের চারা রোপণ করা সবচেয়ে ভালো।

প্রশ্ন ৩: ইরি ধানের জন্য কোন জাত সবচেয়ে ভালো?
উত্তর:
ব্রি ধান-২৮, ব্রি ধান-২৯ এবং ব্রি ধান-৮১ কৃষকদের কাছে জনপ্রিয়।

প্রশ্ন ৪: প্রতি বিঘায় কত কেজি ইউরিয়া সার দিতে হবে?
উত্তর:
প্রতি বিঘায় প্রায় ৩০ কেজি ইউরিয়া সার দিতে হবে।

প্রশ্ন ৫: ইরি ধানের গড় ফলন কত হয়?
উত্তর:
উন্নত জাত ও সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলে প্রতি হেক্টরে ৬–৭ টন ফলন পাওয়া যায়।

আরও পড়ুনঃ কোন সারের কি কাজ-পটাশ,টিএসপি,ইউরিয়া,বোরন সারের কাজ কি

শেয়ার করুন
Moshiur Rahman

I am Moshiur Rahman, an enthusiastic writer on agricultural information and research. I strive to deliver reliable and easy-to-understand information on modern agricultural technology, crop production, agricultural loans, and agricultural development, so that farmers and all those involved in agriculture can benefit.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Scroll to Top